Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ সবার দেশ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১১:৩৪, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

সাত সরকারি কলেজ ঢাবি থেকে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন 

সাত সরকারি কলেজ ঢাবি থেকে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন 
ফাইল ছবি

দীর্ঘদিনের আলোচনা, শিক্ষার্থীদের দাবি এবং প্রশাসনিক জটিলতার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে অধিভুক্ত সাতটি সরকারি কলেজের ‘সম্মানজনক পৃথকীকরণ’ চূড়ান্ত করা হয়েছে। 

২৪ এপ্রিল ২০২৫-এ ঢাবির সিন্ডিকেট সভায় এ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা সাত কলেজের প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে সাত কলেজ স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় পরিচালিত হবে, যা তাদের শিক্ষার মান, ব্যবস্থাপনা এবং স্বতন্ত্র পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সাতটি সরকারি কলেজ—ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজ—দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তবে এই অধিভুক্তির কারণে প্রশাসনিক জটিলতা, ভর্তি প্রক্রিয়ায় অসুবিধা, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব, এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি পূরণে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামোর দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছিল। এছাড়া, ঢাবির প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর অতিরিক্ত চাপ কমাতে এবং সাত কলেজের শিক্ষার মান উন্নয়নে স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তা বারবার উঠে এসেছে।

২০১৭ সালে সাত কলেজের অধিভুক্তি ঢাবির অধীনে আনার পর থেকেই এ জটিলতা আরও প্রকট হয়। শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ, শিক্ষকদের প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা এবং অবকাঠামোগত ঘাটতি নিয়ে সমালোচনা তীব্র হতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এবং ঢাবি কর্তৃপক্ষের মধ্যে একাধিকবার আলোচনা হয়। অবশেষে, ইউজিসির সুপারিশ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মতির ভিত্তিতে এ পৃথকীকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

২৪ এপ্রিল ২০২৫-এ বিকেল ৫টায় ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে সাত কলেজের ভর্তি কার্যক্রম, পরীক্ষা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হবে না। এর পরিবর্তে, সাত কলেজ একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হবে।

ঢাবির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মুন্সী শামস উদ্দিন আহম্মদ জানান, পৃথকীকরণের ফলে আগামী শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা নতুন কাঠামোর অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। তবে, রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ঢাবি প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে প্রস্তুত থাকবে। এছাড়া, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের চলমান শিক্ষা কার্যক্রমে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য একটি রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে।

সাত কলেজের দীর্ঘমেয়াদি প্রশাসনিক সমাধান হিসেবে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (ডিসিইউ)’ নামে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইউজিসি এ প্রস্তাব ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, এবং এটি এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সাত কলেজ একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হবে। এ অন্তর্বর্তী কাঠামোর বিস্তারিত ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক সেবা নিরবচ্ছিন্ন রাখবে।

নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশ হবেন, যা তাদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। এছাড়া, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রম, গবেষণা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি হবে।

প্রভাব ও গুরুত্ব

সাত কলেজের বিচ্ছিন্নতা শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, বরং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী উপকৃত হবেন। প্রধান প্রভাবগুলো হলো:

  • প্রশাসনিক স্বাধীনতা: সাত কলেজ নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে ভর্তি, পরীক্ষা, ফলাফল প্রকাশ এবং অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে, যা পূর্বের বিলম্ব এবং জটিলতা কমাবে।
  • শিক্ষার মান উন্নয়ন: স্বতন্ত্র কাঠামোর মাধ্যমে কলেজগুলো নিজস্ব পাঠ্যক্রম, গবেষণা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করতে পারবে।
  • অবকাঠামোগত উন্নয়ন: নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কলেজগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি এবং ডিজিটাল সুবিধা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে।
  • শিক্ষার্থীদের সুবিধা: শিক্ষার্থীরা দ্রুত এবং সুষ্ঠু প্রশাসনিক সেবা পাবেন, যা তাদের একাডেমিক অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করবে।
  • স্বতন্ত্র পরিচয়: সাত কলেজ একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজস্ব ঐতিহ্য ও পরিচয় গড়ে তুলতে পারবে।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা: নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের কাঠামো কার্যকরভাবে পরিচালনা করা।
  • অর্থায়ন: নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং কলেজগুলোর উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করা।
  • শিক্ষক ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ: স্বতন্ত্র প্রশাসন পরিচালনার জন্য শিক্ষক ও কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি।
  • শিক্ষার্থীদের আস্থা: শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন কাঠামোর প্রতি আস্থা তৈরি করা এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের কাঠামো দ্রুত ঘোষণা এবং নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রচেষ্টা চলছে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। শিক্ষক সমিতি, শিক্ষার্থী নেতারা এবং শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, এটি সাত কলেজের শিক্ষার মান এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে, তারা দ্রুত বাস্তবায়ন এবং স্বচ্ছ প্রশাসনের ওপর জোর দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত সরকারি কলেজের বিচ্ছিন্নতা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতে একটি মাইলফলক। এ সিদ্ধান্ত সাত কলেজকে স্বতন্ত্র পরিচয়, উন্নত শিক্ষা পরিবেশ এবং প্রশাসনিক স্বাধীনতা প্রদান করবে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ কলেজগুলো আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে। তবে, সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং পর্যাপ্ত সহায়তা নিশ্চিত করা হলে এ রূপান্তর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখবে।

সবার দেশ/কেএম