Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:৩৮, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন

হিন্দু বোর্ডে মুসলিম নেই, ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দু কেন?

প্রধান বিচারপতি বলেন, দিল্লি হাইকোর্টও ওয়াকফ জমির ওপর তৈরি। ১৩, ১৪ বা ১৫ শতাব্দীতে তৈরি মসজিদের কাগজপত্র পাওয়া অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, ওয়াকফ বাই ইউজার সবসময় ভুল নয়। যেমন, আদালত যে জমি ব্যবহার করছে, তারও কোনো কাগজপত্র নেই, তবু এটি ওয়াকফ সম্পত্তির অংশ।

হিন্দু বোর্ডে মুসলিম নেই, ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দু কেন?
ছবি: সংগৃহীত

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। ১৬ এপ্রিল ২০২৫-এ এ আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা ৭৩টি পিটিশনের শুনানি হয়। 

প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বে বিচারপতি সঞ্জয় কুমার ও কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য নিয়োগের বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট জবাব দাবি করেছে।

সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন

শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, হিন্দু দেবোত্তর বোর্ডের সদস্য হিসেবে কোনো মুসলিমকে সদস্য হতে দেবে সরকার? খোলাখুলি বলুন। যদি না দেয়, তবে ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দু কেনো? তিনি আরও উল্লেখ করেন, ওয়াকফ বোর্ডে ২২ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ৮ জন মুসলিম কেনো? হিন্দু ধর্মীয় বোর্ডে কি মুসলিমদের স্থান দেয়া হবে?

এ প্রশ্নের মাধ্যমে আদালত ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য নিয়োগের যৌক্তিকতা এবং অন্যান্য ধর্মীয় বোর্ডের তুলনায় এ নিয়মের সামঞ্জস্যতা নিয়ে সরকারের অবস্থান পরীক্ষা করতে চেয়েছে। প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, এ আইনের ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ছড়াচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের বিতর্কিত দিক

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫ ভারতের লোকসভায় ৮ আগস্ট ২০২৪-এ পেশ করা হয় এবং ২০২৫-এ পাস হয়। এই আইন ১৯২৩ সালের মুসলমান ওয়াকফ আইন বাতিল এবং ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধনের প্রস্তাব করে। এর মূল বিতর্কিত বিষয়গুলো হলো:

  • অমুসলিম সদস্য নিয়োগ: নতুন আইনে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য এবং এমনকি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে অমুসলিম নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, কারণ হিন্দু দেবোত্তর বোর্ড, শিখ গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটি, বা অন্য ধর্মীয় সংস্থাগুলোতে শুধুমাত্র নিজ নিজ ধর্মের সদস্যরাই থাকেন।
  • ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বিলুপ্তি: ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় বা দানের কাজে ব্যবহৃত সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে গণ্য হয়, এমনকি কাগজপত্র না থাকলেও। নতুন আইনে বলা হয়েছে, বিরোধপূর্ণ বা সরকারি জমিতে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না এবং বৈধ কাগজপত্র ছাড়া সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে গণ্য হবে না। এটি ভারতের ৮.৭ লাখ ওয়াকফ সম্পত্তির মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ সম্পত্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
  • জেলা প্রশাসকের ক্ষমতা: আইনে জেলা প্রশাসক বা সমপদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তাকে ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা যাচাই ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এটি সরকারের হস্তক্ষেপ বাড়াবে এবং ওয়াকফ সম্পত্তি রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।

পিটিশনকারীদের যুক্তি

পিটিশনকারীদের পক্ষে আইনজীবী কপিল সিবাল যুক্তি দেন, ওয়াকফ ইসলামের একটি মৌলিক অংশ এবং এর সঙ্গে হস্তক্ষেপ সংবিধানের ২৬ নম্বর ধারা (ধর্মীয় স্বাধীনতা) লঙ্ঘন করে। তিনি বলেন, হাজার বছর আগের ওয়াকফ সম্পত্তির কাগজপত্র চাওয়া অযৌক্তিক।

আইনজীবী অভিষেক সিংভি উল্লেখ করেন, ভারতের ৮ লাখ ওয়াকফ সম্পত্তির প্রায় অর্ধেক ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’। নতুন আইনের কাগজপত্রের শর্তের কারণে এসব সম্পত্তি রাষ্ট্রের হাতে চলে যেতে পারে, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকারের ওপর আঘাত।

সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য

প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না বলেন, দিল্লি হাইকোর্টও ওয়াকফ জমির ওপর তৈরি বলে শুনেছি। ১৩, ১৪ বা ১৫ শতাব্দীতে তৈরি মসজিদের কাগজপত্র পাওয়া অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, ওয়াকফ বাই ইউজার সবসময় ভুল নয়। যেমন, আদালত যে জমি ব্যবহার করছে, তারও কোনো কাগজপত্র নেই, তবু এটি ওয়াকফ সম্পত্তির অংশ।

আদালত এ আইনের বাস্তবায়নের ওপর স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করলেও সরকারের কাছে এর যৌক্তিকতা নিয়ে বিস্তারিত জবাব চেয়েছে।

সমালোচনা ও বিক্ষোভ

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন পাসের পর ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এ আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এ আইন মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সম্পত্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে এবং হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার অংশ।

কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, হিন্দু মন্দির পরিচালনা কমিটিতে অন্য ধর্মের লোক স্থান পায় না, তাহলে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম কেন?

সরকারের অবস্থান

কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি দাবি করছে, এ সংশোধনী ওয়াকফ বোর্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আমিত শাহ বলেছেন, ওয়াকফ কাউন্সিল বা বোর্ডে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্তি কেবল প্রশাসনিক কাজের জন্য, ধর্মীয় বিষয়ে নয়। তিনি এ আইনকে মুসলিম সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এটি ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির জন্য ভীতি ছড়ানোর প্রচেষ্টা।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের ন্যায্যতা এবং সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। আদালতের মূল প্রশ্ন—হিন্দু বা অন্য ধর্মীয় বোর্ডে অন্য ধর্মের সদস্য না থাকলে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম কেন—এ আইনের সমতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে সরকারকে জবাবদিহির মুখে ফেলেছে। ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ এবং কাগজপত্রের শর্তের মতো বিষয়গুলো মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ মামলার পরবর্তী শুনানি এবং আদালতের চূড়ান্ত রায় ভারতের ধর্মীয় সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সূত্র: এনডিটিভি, আনন্দবাজার, উইকিপিডিয়া, দ্য হিন্দু, হিন্দুস্তান টাইমস, এক্স পোস্ট।

সবার দেশ/কেএম