Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:৫০, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ০০:৫১, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

কোলকাতা ও ঢাকা থেকে যৌথ অনুসন্ধান  

আ’লীগের জালিয়াতিতে অতিষ্ঠ কোলকাতার প্রশাসন

আ’লীগের জালিয়াতিতে অতিষ্ঠ কোলকাতার প্রশাসন
ছবি: সবার দেশ

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কোলকাতায় জাল পাসপোর্ট, ভুয়া পরিচয়পত্র, অবৈধ সম্পত্তি ক্রয় এবং চিকিৎসা বা ব্যবসার নামে আর্থিক লেনদেনের ভয়াবহ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। 

বিষয়টি এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, কোলকাতা পুলিশ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (CBI) এখন বিশেষ নজরদারিতে রেখেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন বেশ কয়েকজন ‘ভিআইপি’র গতিবিধি।

কোলকাতায় জালিয়াতির ঘাঁটি গড়ে তুলেছেন একদল প্রভাবশালী ‘ভিজিটর’
  
সূত্র জানায়, গত তিন বছরে অন্তত ১৭ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও তাদের আত্মীয়-স্বজন কোলকাতায় ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে চিকিৎসা, ব্যবসা বা জমি ক্রয়ের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন করেছেন, যার বেশিরভাগই ‘হাওলা চ্যানেল’ হয়ে এসেছে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে ভারতের ফরেনার্স অ্যাক্ট ও ম্যানি লন্ডারিং আইনে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

জাল আধার, ভুয়া ভোটার আইডি, এমনকি ভুয়া ভারতীয় নাগরিকত্ব!

ভারতের নির্বাচন কমিশন ও UIDAI-এর একাধিক তদন্তে দেখা গেছে, বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কোলকাতার সল্টলেক, নিউটাউন এবং টালিগঞ্জ এলাকায় জাল আধার কার্ড বানিয়ে রেখেছেন।  এর মাধ্যমে তারা ভারতের ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা পাচার করছেন। কলকাতা পৌর কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশি রাজনৈতিক লোকজনের অনুপ্রবেশ এখন আর শুধু ‘অনুপ্রবেশ’ নয়, এটা একটা করপোরেট-রাজনৈতিক সিন্ডিকেট; যার শেকড় বাংলাদেশের সাবেক সরকারি দল পতিত আওয়ামীলীগ।

কোলকাতা প্রশাসনের উদ্বেগ: আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক টানাপড়েন?

CBI ও কোলকাতা পুলিশের যৌথ তদন্তে সন্দেহজনক অন্তত ২৬টি সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে, যেগুলোর মালিকানায় রয়েছে আওয়ামী লীগের দুই এমপির পরিবারের সদস্যদের নাম।  ভারতের এক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা যায়, এ সব সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত হয়েছে ভারতীয় ভোটার আইডি—যা ছিল সম্পূর্ণ জাল।  
  
পশ্চিমবঙ্গের একজন সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের সাবেক সরকার প্রধান শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহলের কয়েকজন ব্যক্তি কোলকাতায় যে পরিমাণে বিনিয়োগ করেছেন, তা স্বাভাবিক নয়। বিষয়টি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

চিকিৎসার নামে কোটি কোটি টাকা পাচার  

‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা’র অজুহাতে কোলকাতার নামীদামি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তির প্রবণতা রয়েছে কিছু ভিআইপি বাংলাদেশির। তবে বাস্তবে, এসব ‘চিকিৎসা ট্রিপ’ অধিকাংশ সময় ব্যবহৃত হয় হাওলা মাধ্যমে টাকা স্থানান্তর এবং রাজনৈতিক ডিলমেকিংয়ের জন্য।
  
২০২৩ সালে একজন সাবেক আওয়ামী লীগ যুবনেতার নামে কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা বাবদ দেখানো হয়েছিলো প্রায় ৬৫ লাখ টাকা, অথচ চিকিৎসার ধরণ ছিলো সাধারণ রুটিন চেকআপ।

৫ আগস্টের পর পলাতক আওয়ামী নেতা যারা কোলকাতায়, তারাই জড়িত এ জালিয়াতি চক্রে?

৫ আগস্ট ২০২৩ থেকে ভারতের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো (CBI) কোলকাতা অঞ্চলে বিদেশি নাগরিকদের পরিচয় জালিয়াতি এবং অর্থপাচার সম্পর্কিত বিশেষ নজরদারির আওতায় অভিযান পরিচালনা শুরু করে। এতে লক্ষ্যবস্তুতে উঠে আসে একাধিক বাংলাদেশি, যাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

বিশ্বস্ত সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর অবৈধভাবে কলকাতায় অবস্থানরত কয়েকজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা হলেন:

  • মো. সিরাজুল হক চৌধুরী (ছদ্মনাম) — সাবেক এমপি, রংপুর বিভাগ  
  • অবস্থান: কলকাতা নিউটাউনের একটি গেস্টহাউসে  
  • অভিযোগ: জাল ভোটার আইডি ব্যবহার করে ভারতীয় সিম কার্ড ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা। একটি অভিজাত হাসপাতালে প্রায় ৪৮ লাখ টাকা ‘চিকিৎসা খাতে’ খরচ দেখানো।  
  • আবু হেনা রিয়াজ (ছদ্মনাম) — বর্তমান এমপি, খুলনা অঞ্চল  
  • অবস্থান: বারাসাতের এক ব্যবসায়ীর ফ্ল্যাটে  
  • অভিযোগ: স্ত্রী ও দুই ছেলের নামে ভারতীয় পরিচয়পত্র জোগাড় করে নিউটাউনে ফ্ল্যাট কেনা। CBI সূত্র বলছে, হাওলা মাধ্যমে অর্থ পাচারে যুক্ত।  
  • সাবেক প্রতিমন্ত্রী ‘ম’ – গাজীপুর এলাকা (নাম সংরক্ষিত)  
  • অবস্থান: কলকাতার পার্কসার্কাস এলাকায়  
  • অভিযোগ: ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় আধার ব্যবহার করে গাড়ি কেনা। বর্তমানে একজন দালালের মাধ্যমে ভারতীয় পাসপোর্ট প্রস্তুতের চেষ্টায় ছিলেন। কলকাতা পুলিশের ‘স্পেশাল ব্রাঞ্চ’ সূত্রে এটি নিশ্চিত।  
  • মহিলা সাংগঠনিক নেত্রী (নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক), নারায়ণগঞ্জ  
  • অবস্থান: কলকাতা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন একটি হোটেলে  
  • অভিযোগ: সরকারি অর্থে চিকিৎসার নামে দীর্ঘ সময় অবস্থান, কিন্তু মূলত অর্থপাচার ও রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগের লেনদেন।  

তারা কিভাবে জড়িত?

  • ভুয়া পরিচয়পত্র: তারা স্থানীয় দালাল চক্রের মাধ্যমে আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার আইডি সংগ্রহ করে—যা ব্যবহার করে ব্যাংক, হাসপাতাল, মোবাইল ও এমনকি জমি রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত করে ফেলেন।
  • হাওলা  হাব: এ নেতারা হাওলা  চ্যানেলে বাংলাদেশ থেকে কালো টাকা ভারতে পাঠিয়ে তা ‘চিকিৎসা’, ‘ভিসা ফি’, বা ‘ব্যবসা’ খাতে ঢুকিয়ে দেন—যার মাধ্যমে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা হয়।
  • কোলকাতাকে নিরাপদ ‘সেকেন্ড হোম’ বানানো: বহুজনের স্ত্রী-সন্তান নিয়মিত কলকাতার স্কুল-কলেজে পড়ছে। অনেকে ভিসা মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবস্থান করছেন, যা ফরেনার্স অ্যাক্ট লঙ্ঘন।

দিল্লির কূটনৈতিক বার্তা: বাংলাদেশ সরকার সতর্ক হোক  

ভারতের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বার্তা দিয়েছে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।  

একাধিক কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ভারতের শাসকদল বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এখন এ ‘আওয়ামী লীগ করাপশন লবি’কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং ভবিষ্যতে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে।

ভারতের গোয়েন্দা মহল বিষয়টি শুধু অর্থপাচার নয়, রাজনৈতিক নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখছে। সংশ্লিষ্ট কিছু নাম ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘ওয়াচ লিস্ট’-এ স্থান পেয়েছে। সূত্র বলছে, বাংলাদেশ হাইকমিশনকে এ নিয়ে বারবার মৌখিক সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে।

এ ঘটনাগুলো আর বিচ্ছিন্ন নয়। এটি এখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক সিন্ডিকেট, যেখানে ক্ষমতার ছায়াতলে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক জালিয়াতির সমান্তরাল প্রশাসন।

শেষকথা  

বাংলাদেশের সাবেক ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী কোলকাতায় যে ‘ছদ্মবেশী সাম্রাজ্য’ গড়ে তুলেছে, তা এখন আর কেবল কোলকাতার ‘ওপেন সিক্রেট’ নয়—এটি এক নতুন ধরনের অন্তর্রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক অপরাধচক্র, যেখানে প্রশাসন, কর্পোরেট ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা জড়িত।  

এখন প্রশ্ন—বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কি আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ভিনদেশে করা এ লজ্জাজনক জালিয়াতি রোখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে, নাকি কোলকাতার প্রশাসনের মতো তারাও মুখ ফিরিয়ে রাখবে? এখন না হয় তারা পতিত আওয়ামী লীগ ও তাদের সো কল্ড ‘মুখ্যমন্ত্রী’ মাফিয়া হাসিনার সঙ্গে তাদের ‘হানিমুন পিরিয়ড’ ভুলতে পারছে না, কিন্তু আর কতদিন! একদিন এ দিল্লি আর কোলকাতাও বর্তমানে ‘একাত্তর’র মতো খোঁটা দিয়ে বলবে ‘আমরা ২০২৪ সালেও বাংলাদেশের পাশে ছিলাম, আশ্রয় দিয়েছি, খাবার দিয়েছি’। ভবিষ্যত বাংলাদেশ কি এমন বয়ান শুনতে প্রস্তুত, না-কি ভারতে পালিয়ে থাকা পতিত আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে দ্বি-পাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নিবে? 

সবার দেশ/কেএম