পেহেলগাম হামলায় উত্তেজনার নতুন মাত্রা
যুদ্ধে ভারতকে সমর্থনের ঘোষণা ইসরায়েলের

জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৫ জন ভারতীয় পর্যটক এবং একজন নেপালি নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। এ হামলার প্রেক্ষিতে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে, যদি এ ঘটনার জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো যুদ্ধ বাধে, তবে ইসরায়েল ভারতের পাশে থাকবে।
এ ঘোষণা দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্কের গভীরতা এবং তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের নামে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে তাদের একীভূত অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করেছে।
ইসরায়েলের অবস্থান: নৈতিক ও কৌশলগত সমর্থন
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমোরস্টেইন রিপাবলিক মিডিয়া নেটওয়ার্কের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা ভারতের পাশে আছি। এটি আমাদের নৈতিক অবস্থান। বন্ধু এভাবেই বন্ধুর পাশে থাকে। তিনি পেহেলগাম হামলার সঙ্গে ইসরায়েলের নিজস্ব অভিজ্ঞতার তুলনা করে বলেন, ইসরায়েলের মাটিতে যে হামলা ঘটেছিলো, তার সঙ্গে এ হামলার অনেকটা মিল রয়েছে। পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও হত্যাযজ্ঞের চরিত্র একই। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ভারতের মতো ইসরায়েলও জিহাদি উগ্রবাদী সন্ত্রাসবাদের শিকার, এবং নির্দোষ নাগরিকদের উপর এ ধরনের আক্রমণের যন্ত্রণা তারা গভীরভাবে উপলব্ধি করে।
ইসরায়েলের এ বিবৃতি কেবল নৈতিক সমর্থনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইসরায়েল ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। ইসরায়েল ভারতের বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশগুলোর একটি। ২০১৭ সালে ভারত ইসরায়েলের কাছ থেকে প্রায় ৫৩০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের অস্ত্র ক্রয় করেছিলো, যার মধ্যে ছিলো বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাডার এবং ক্ষেপণাস্ত্র। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর ইসরায়েল ভারতকে উন্নত নজরদারি সরঞ্জাম, স্যাটেলাইট ইমেজিং এবং সীমান্ত নিরাপত্তা প্রযুক্তি সরবরাহ করে। এ সহযোগিতা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার ভিত্তি তৈরি করেছে।
পেহেলগাম হামলা ও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা
পেহেলগামে সংঘটিত এ হামলায় দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেসিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ), যারা পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি সহযোগী গোষ্ঠী বলে পরিচিত। ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দাবি, এ হামলায় চারজন সন্ত্রাসী জড়িত ছিলো, যাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি এবং দুজন ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের। ভারত অভিযোগ করেছে যে, পাকিস্তান কাশ্মীরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দিচ্ছে, যা পাকিস্তান অস্বীকার করেছে।
হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদী পানি চুক্তি স্থগিত করা, ওয়াঘা-আটারি সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করা, পাকিস্তানিদের জন্য সার্ক ভিসা ছাড় প্রকল্প বাতিল করা এবং পাকিস্তানি কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের ভারত থেকে বহিষ্কার। পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি স্থগিত, ভারতীয় বিমানের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ এবং দুই দেশের মধ্যে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।
এ পদক্ষেপগুলো দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে চরমে নিয়ে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে, পেহেলগাম হামলা এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দুই দেশকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের সমর্থন ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ইসরায়েল-ভারত সম্পর্ক: সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একীভূত অবস্থান
ইসরায়েল ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক গত তিন দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়েছে। ১৯৯২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে দুই দেশ প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তি সহযোগিতায় গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময় ইসরায়েল ভারতকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিলো। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর ভারত ইসরায়েলি স্পাইস-২০০০ গাইডেড বোমা ব্যবহার করে পাকিস্তানের বালাকোটে সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে আঘাত হানে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু পেহেলগাম হামলার পর এক টুইটে বলেন, আমার বন্ধু নরেন্দ্র মোদী, পেহেলগামে এ বর্বর সন্ত্রাসী হামলায় আমি গভীরভাবে মর্মাহত। আমাদের চিন্তা ও প্রার্থনা ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের সঙ্গে। ইসরায়েল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের পাশে রয়েছে।
ইসরায়েলের এ সমর্থন শুধুমাত্র কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইসরায়েল ভারতকে গোয়েন্দা তথ্য, উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি এবং সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল শেয়ার করতে পারে। ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত রুভেন আজারু বলেছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এবং সন্ত্রাসীদের জবাব দিতে প্রস্তুত। ভারত সরকারকে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে।
ইসরায়েল-পাকিস্তান সম্পর্ক: শত্রুতার ইতিহাস
ইসরায়েল ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। পাকিস্তান প্যালেস্টাইনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছে। পাকিস্তানের পাসপোর্টে উল্লেখ থাকে যে, এটি ইসরায়েল ব্যতীত সব দেশে ভ্রমণের জন্য বৈধ। পাকিস্তানের জনমতও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের পর এ অনুভূতি আরও তীব্র হয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা করেছে এবং প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার জন্য ১৯৬৭-পূর্ব সীমানা ও পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে সমর্থন করে। এ প্রেক্ষাপটে, পেহেলগাম হামলার পর ইসরায়েলের ভারত সমর্থন পাকিস্তানের জন্য একটি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব ও সম্ভাব্য পরিণতি
ইসরায়েলের এ সমর্থন ভারতের জন্য কৌশলগত সুবিধা প্রদান করলেও, এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পারে। পাকিস্তান ইতিমধ্যে ইরান ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং পাকিস্তানের জনমত ইরানের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে।
অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো ভারত ও ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। পেহেলগাম হামলার পর মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভারতে সফর করছিলেন, যা এ ঘটনার সময়ের সঙ্গে মিলে যায়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ভারতের প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে আরও শক্তিশালী হতে পারে।
তবে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর, এবং যুদ্ধ শুরু হলে তা বৃহত্তর সংঘাতে রূপ নিতে পারে। ইসরায়েলের সমর্থন ভারতের জন্য শক্তি যোগালেও, এটি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ইরান বা অন্য মিত্রদের সমর্থন আকর্ষণ করতে পারে, যা পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে।
পেহেলগাম হামলা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে, এবং ইসরায়েলের ভারত সমর্থন এ সংকটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছে। ইসরায়েলের নৈতিক ও কৌশলগত সমর্থন ভারতের অবস্থানকে শক্তিশালী করলেও, এটি আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন দায়িত্ব হলো পরিস্থিতি নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা, যাতে এ উত্তেজনা যুদ্ধে রূপ না নেয়। ভারত, পাকিস্তান এবং তাদের মিত্রদের সংযত আচরণই এখন একমাত্র পথ হতে পারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার।
সবার দেশ/কেএম