পণ্য কিনতে আগের রমজানের চেয়ে কম টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে ভোক্তাদের
স্থিতিশীল বাজারদরে স্বস্তির রমজান
মোটাদাগে এ বছর রমজানে পণ্যের মূল্য অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশ স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে রয়েছে মুদি পণ্যে ও সব্জির দাম। সবমিলিয়ে এবার মূল্যস্ফীতিও এক অঙ্কের নিচে চলে এসেছে। গড়পড়তায় গত রমজানের দ্রব্যমূল্যের চেয়ে এবারের দ্রব্যমূল্য প্রায় ৭৯% কম।

এবারের রোজায় অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক পণ্যের দাম স্থিতিশীল ছিলো শুরু থেকেই। রোজা শুরুর আগেই বাজারে অরাজকতা এবার দেখা যায়নি। তেল আর চাল বাদে বাজারে তেমন বড় কোনও অসঙ্গতি ছিলো না। তেলের দাম গত বছরের তুলনায় কম হলেও সংকট তৈরির একটা চেষ্টা চলছিলো শুরুর দিকে। এখন সে অস্থিরতাও সামাল দ্রয়েছে সরকার।
গত বছর উত্তাপ ছড়ানো পিয়াজের দামে ব্যাপক দরপতন ঘটেছে। গত রমজানে পিয়াজের দাম উঠেছিলো কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা পর্যন্ত। এবারের রমজানে পণ্যটি কেনা যাচ্ছে ৩০ থোক ৪০ টাকায়। একইসঙ্গে আগের রমজানে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিলো ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। এবার সেটি ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় কেনা যাচ্ছে। রমজানে অতি প্রয়োজনীয় খেজুরের দামও এবার গত রমজানের তুলনায় প্রায় ৩০% কম।
এ ছাড়া এবারের রমজানে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়, গত রমজানে আলুর কেজি ছিলো ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে আগের রমজানের চেয়ে কম টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে ভোক্তাদের। এতে বিগত বছরের তুলনায় এবারের রমজানে মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। মোটাদাগে এ বছর রমজানে পণ্যের মূল্য অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশ স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে রয়েছে মুদি পণ্যে ও সব্জির দাম। সবমিলিয়ে এবার মূল্যস্ফীতিও এক অঙ্কের নিচে চলে এসেছে। গড়পড়তায় গত রমজানের দ্রব্যমূল্যের চেয়ে এবারের দ্রব্যমূল্য প্রায় ৭৯% কম।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, সাধারণত দেশে প্রতি মাসে গড়ে দেড় লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। রমজান মাসে লাগে তিন লাখ টন। এ মাসে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পণ্যটির দামও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এবারের রমজানে চিনির দাম স্থিতিশীল রয়েছে। বরং গত বছরের তুলনায় দাম কমেছে। গত রমজানে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া এ পণ্যটি এবার বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়।
এদিকে রোজার সময় বেগুনির চাহিদা অনেক বেশি থাকে। বাড়তি এ চাহিদার সুযোগে বেগুনের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা। গত বছর রোজায় বেগুনের দাম ১২০ টাকায় উঠেছিলো। এবারও রোজার প্রথম কয়েকদিন বেগুনের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা ছিলো। এখন কিছুটা কমে ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে গত রোজায় প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিলো ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা, সেটির দাম এবার কমে দাঁড়িয়েছে ১১০ থেকে ১২৫ টাকায়। গত রমজানে ১২৫ টাকায় বিক্রি হওয়া ছোলা এবার ১১০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। শসার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গত রোজায় প্রতি কেজি শসার দাম ওঠে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। এবার প্রতি কেজি শসা বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৬০ টাকায়। গত রমজানে তরমুজের কেজি ছিলো ৮০ থেকে ৯০ টাকা, এবার রসালো এ ফলটির কেজি ৪০ থেকে ৬০ টাকা। গত রোজায় মাংসের দামও ছিলো চড়া। প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম উঠেছিলো ৮০০ টাকায়। এবার বাজারে ৭৩০ তেকে ৭৫০ টাকায় গরুর মাংস পাওয়া যাচ্ছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে বেশির ভাগ সবজির দাম এখনো স্বস্তির মধ্যে রয়েছে। বাজারে এখন প্রতি কেজি দেশি গাজর ২০ থেকে ৩০ টাকা, শিম ৩০-৫০ টাকা, উস্তে ৭০ থেকে ৮০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা, শালগম ৩০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০ টাকা, পটোল ৮০ থেকে ১০০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ টাকা, ধুন্দল ৬০ টাকা, ঝিঙা ৭০ টাকা, বরবটি ৭০ টাকা, পিয়াজকলি ৩০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ২০ থেকে ৩০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৪০ তেকে ৫০ টাকা, ধনেপাতা ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মানভেদে প্রতিটি লাউ ৩০ থেকে ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি হালি কাঁচা কলা ৩০ টাকা, লেবু বিক্রি হচ্ছে ৪০-৬০ টাকা করে। টমেটোর দাম এবার মান ভেদে ১০ থেকে ২০ টাকা, যা গত বছর ছিলো ৮০ থেকে ১৪০ টাকা।
ওদিকে গত রমজানের তুলনায় মাছের দামও কমেছে। টিসিবি‘র তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের রমজানে ২৬০ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি কেজি পাঙাস মাছ এবার ২৪০ টাকায়, ২২০ টাকায় বিক্রি হওয়া তেলাপিয়া মাছ ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কই মাছের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।
এদিকে বাজারে পণ্যের দামে স্বস্তির কথা বলেছেন অনেক ক্রেতা। ক্রেতারা বলেন, রমজান হিসাবে বাজারে আগে যে হুলস্থুল পরিস্থিতি থাকতো সেটা এবার নেই। বেশির ভাগ পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে রয়েছে। তবে চালের দাম এবার বেশি। তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। গত বছরের রোজার চেয়ে এবারের রোজায় বেশির ভাগ জিনিসের দাম কমেছে। পিয়াজ, আলুর দাম নাগালের মধ্যে এসেছে। আর মুরগির দামও স্থিতিশীল রয়েছে। রোজা উপলক্ষে জিনিসের দাম খুব বেশি হেরফের হয়নি। এজন্য এবারের রোজায় জিনিস কিনে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছি।
অস্বস্তি শুধু ভোজ্য তেল আর চালে: এবারের রমজানে অস্বস্তি বাড়িয়েছে ভোজ্য তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরির খেলা। চলতি রমজানের আগে থেকেই শুরু হয় বাজারে ভোজ্য তেল নিয়ে অস্থিরতা। খোলা বাজারে দেখা দেয় সংকট। দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জেও দেখা দেয় সংকট। হিসাব বলছে, দেশে প্রতি মাসে সয়াবিনের চাহিদা থাকে গড়ে ৮৭ হাজার টন। রোজায় এ চাহিদা কিছুটা বাড়ে। তবে, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে আমদানি করা হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন তেল, যা আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। তবুও বাজারে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমতিই ছিলো। এছাড়া সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সয়াবিন বিক্রির চেষ্টা করেছে কেউ কেউ। বাজারে এখন প্রতি লিটার খোলা বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকায়।
এমন প্রেক্ষাপটে গত ৩রা মার্চ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কাঁচাবাজার পরিদর্শন শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, আগামী দুইদিনের মধ্যে সয়াবিন তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। গত কয়েক দিনে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কিছুটা বাড়ায় উপদেষ্টার আশ্বাসের সত্যতা মিলেছে। তবে সন্তোষজনক নয়। রোজার শুরুতে সয়াবিন তেলের যে সরবরাহ সংকট ছিল তাও এখন কমেছে।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আশার কথা হচ্ছে, এখন সংকট কাটিয়ে আবারো বাজারে বোতলজাত তেলের সরবরাহ বাড়তে শুরু করেছে। সরকারের উচিত হবে, এ সরবরাহের ধারা যেন বজায় থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা।
এদিকে চালের বাজারে এখনও অস্বস্তি বিরাজ করছে। আমদানি শুল্ক কমলেও সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা, বরং কোনো কোনো চালের দর বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দরে। এক মাস ধরে এ দরেই রয়েছে মোটা চাল। গত এক মাসে মাঝারি ও সরু চাল কেজিতে দুই টাকা বেড়েছে। বর্তমানে মাঝারি চাল ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা ও সরু চাল ৭২ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে, খাদ্যেও স্বস্তি: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেয়া ফেব্রুয়ারি মাসের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৩২ শতাংশ, যা জানুয়ারি মাসে ছিল ৯.৯৪ শতাংশ। পাশাপাশি খাদ্য খাতে ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯.২৪ শতাংশ, যা জানুয়ারি মাসে ছিল ১০.৭২ শতাংশ। বিবিএস জানায়, ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যপণ্যের দামে স্বস্তি মিলেছে। এর মধ্যে আলু, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি ও মসলার দাম কমেছে।
বাজার তদারকিতে ১৩ টিম: আলু, পিয়াজ, চাল, ডাল, চিনি, ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৩টি পৃথক টিম কাজ করছে। অধিদফতরের উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ ও প্রচার) আফরোজা রহমান এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
সবার দেশ/কেএম